পচাব্দী গাজী সুন্দরবন অঞ্চলের কিংবদন্তি শিকারি। তিনি সুন্দরবন এলাকায় প্রচুর মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছেন।
মোট ৫৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে তিনি সুন্দরবনের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শিকারি হয়েছেন। বাঘের চেয়েও তীক্ষ্ন ছিল তাঁর চোখ। রক্ষা করেছেন সুন্দরবন এলাকার শত শত মানুষের প্রাণ।
সুন্দরবনের নিকটবর্তী গাবুরা ইউনিয়নের গ্রাম সেরা। এই গ্রামের শিকারি পরিবারে ১৯২৪ সালে পচাব্দী গাজী জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মেহের গাজীও বাঘ শিকারি ছিলেন। বাঘ শিকার করেছেন দাদা ইসমাইল গাজীও। বাবা-দাদা দুজনই বাঘের আক্রমণে মারা যান।
পচাব্দী গাজীর পুরো নাম আব্দুল হামিদ গাজী। পিতা মেহের গাজী, পিতামহ ইসমাইল গাজী এবং দুই পিতৃব্যও ছিলেন খ্যাতনামা শিকারী।
১৯৪১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে 'গোলখালির সন্ত্রাস' নামে পরিচিত মানুষখেকো বাঘ হত্যা করে বাঘ শিকারির খাতায় নাম লেখান। এরপর একের পর এক বাঘ হত্যা করে রেকর্ড গড়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে বাঘ শিকার করলেও ১৯৫৫ সালের দিকে তিনি বনরক্ষীর চাকরি পান। এই চাকরি পাওয়ার পর তিনি বন কর্মকর্তা ও সুন্দরবন এলাকার গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছেন।সরকারের বৈধ শিকারির সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি মানুষখেকো বাঘ হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছেন।
আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন শিকারের কৌশল। সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে পচাব্দী গুলি ছুড়ে বাঘ হত্যা করেছেন। আবার টোপ ফেলে গাছের মগডালে বসে বাঘ মেরেছেন।
তিনি বাঘিনীর ডাক, গাছ কাটার শব্দ কিংবা পাতা সংগ্রহের শব্দ নকল করে তিনি বাঘকে প্রলুব্ধ করতেন। জঙ্গলে কল পেতে কিংবা ১৫ হাত উঁচু মাচান তৈরি করেও তিনি শিকার করতেন।
পচাব্দী গাজী সুপতির মানুষখেকো, গোলখালির মানুষখেকো, দুবলার চরের মানুষখেকো, লক্ষ্মী খালের মানুষখেকো, আঠারোবেকির মানুষখেকো বা তালপট্টির মানুষখেকো বাঘ হত্যা করেছেন। তালপট্টির সন্ত্রাস নামে খ্যাত ৫৭তম বাঘ শিকারের মাধ্যমে তাঁর শিকার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিকার হচ্ছে আঠারোবেকির সন্ত্রাস।
বাঘ হত্যার ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা যায়, ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর ৮৭টি বাঘ শিকার করেন। ওই বছর স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান এক দিনের ব্যবধানে মধ্য প্রদেশের মান্তু দুর্গের কাছে চারটি বাঘ হত্যা করেন। রেল কর্মকর্তা ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শিকারি ডাব্লিউ রাইস ১৮৫০ থেকে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে চার বছরে ১৫৮টি বাঘ শিকার করেন। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র দুই বছরে নর্মদা নদীর পাশ থেকে ৭৩টি বাঘ শিকার করেন আরেক ব্রিটিশ শিকারি আর গর্ডন কামিং। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মধ্য প্রদেশের বনাঞ্চল থেকে ৬০০টি বাঘ শিকার করেন আরেক ব্রিটিশ শিকারি বি সাইমন। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ শিকারি মন্টেগু জিরার্ড মধ্য ভারত ও হায়দরাবাদ থেকে ২২৭টি বাঘ শিকার করেন। মহারাজা স্যার গুর্জার ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১১৫০টি বাঘ শিকার করেন। গুর্জারের দেখাদেখি উদয়পুরের মহারাজা ফতে সিং এক হাজারটি বাঘ হত্যা করেন। এ সময় গোয়ালিওর মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়া ৮০০, রেওয়ার মহারাজা গুলাব সিং ৬১৬, কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ৩৭০টি বাঘ শিকার করেছেন। কিন্তু এগুলো ছিল নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বিনা অপরাধে শুধু রাজরাজড়াদের খেয়াল মেটাতে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে এসব বাঘ। তাঁরা কেউ মানুষখেকো বাঘ হত্যা করেননি। হত্যা করেননি ডোরাকাটা দুর্ধর্ষ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। শিকার করেননি পচাব্দীর মতো ১২ ফুট লম্বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ওই শিকারিরা মেছো বাঘ, চিতা বাঘ কিংবা জঙ্গলের স্বাধীন বাঘের মতো প্রাণী পাইক-পেয়াদা নিয়ে হত্যা করে উল্লাস করেছেন, বাঘ শিকারের ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু গ্রামের একজন সহজ-সরল মানুষ, যিনি নিজের বুদ্ধিমত্তায় পাকিস্তানের তৈরি একনলা সেকেন্দার বন্দুক দিয়ে ২৩টি মানুষখেকো, সব মিলিয়ে ৫৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করে নতুন এক ইতিহাস গড়েছেন, তাঁর কথা যেন ভুলে না যাই।
শ্রেষ্ঠ শিকারির খেতাব নিয়ে ১৯৯৭ সালে মারা যান।
0 মন্তব্যসমূহ