উড়োজাহাজ শিল্প, গাড়িশিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার হচ্ছে। পাটের মন্ড থেকে কাগজ তৈরির কথা আমরা অনেকবার শুনেছি। বিশ্বব্যাপী কাগজ তৈরির মন্ডের যে চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশও যদি পাট পুরণ করতে পারে তবে বাংলাদেশের পাট-অর্থনীতি গার্মেন্টর চেয়েও বেশি অবদান রাখতে পারে। আমরা এও জানি, বাংলাদেশেরই এক বিজ্ঞানী পাট থেকে ‘মিহিতন্তু’ আবিষ্কার করেছেন। এই তন্তু হতে পারে ভুলাজাত তন্তুর বিকল্প। আবিস্ককর্তার দাবী, গুণে-মানে তুলাজাত তন্তুর চেয়ে পাটের মিহিতন্তু উত্তম। এ দিয়ে উত্তম কাপড় তৈরি হতে পারে এবং দেশের পাটকলগুলোতে সামান্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সাধন করে মিহিতন্তু দিয়ে কাপড় উৎপাদন করা সম্ভব।পাটকে বলা হয় ‘সোনালী আঁশ’। পাট যে এর চেয়েও অনেক কিছু, বিভিন্ন আবিষ্কারে তার প্রমাণ আমরা পাই।
সোনালী ব্যাগ হলো পাট থেকে উদ্ভাবিত এক ধরনের পলিথিন ব্যাগ। পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের এই প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান(বিজ্ঞানী,পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ জুটমিল কর্পোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা)। এটি একটি সেলুলোজ-ভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক, যা প্লাস্টিক ব্যাগের একটি বিকল্প।পাট থেকে সেলুলোজ আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হয় সিট। তা থেকেই তৈরি হয় ব্যাগ। উদ্ভাবক দাবি করেছেন, পাট থেকে তৈরি পলিথিন ব্যাগ প্রচলিত পলিথিনের তৈরি ব্যাগের চেয়ে অধিক কার্যকর। এ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করার পর ফেলে দিলে সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উপরন্ত তা মাটিতে সারের কাজ করে। সহজলভ্য উপাদন এবং সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এ পলিথিন ব্যাগ বিদেশে রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে অস্টেলিয়া, জাপান, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ সোনালী ব্যাগ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে।প্রাথমিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে দৈনিক ৩ টন।পাটকলগুলোতেই এর উৎপাদন হতে পারে। তাছাড়া যে কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে এর কারখানা স্থাপন করতে পারে। স্বল্প পরিমাণে সোনালী ব্যাগ উৎপাদিত হওয়ায় এর বিপনন এখনো সীমিত। প্রতি ব্যাগের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা। অধিক পরিমাণ উৎপাদিত হলে দাম প্রতিটি ৫০ পয়সায় নামিয়ে আনা সম্ভব।সোনালী ব্যাগ প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হতে পারে। প্রচলিত ‘অক্ষয়’ পলিথিন ব্যাগের কারণে পরিবেশ দূষণ, ভূমির উর্বরতাশক্তি হ্রাস, নদনদী ভরাট, শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব যদি সোনালী ব্যাগ প্রয়োজন মত উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এর ফলে পাটের অর্থনীতিও অনিবার্যভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
যে পলিথিন ব্যাগ আমরা বাজারে দেখতে পাই, তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮২ সালে। যে ইথাইলিন (মলিকিউলাস) থেকে পলিথিন বা পলিথাইলিন উৎপাদিত হয় তা পরিবেশের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকারক। এ পলিথিন ব্যাগ কোনোভাবেই এমন কি পুড়িয়েও ধ্বংস করা যায় না। ফলে জমিতে, পানিতে, ড্রেনে যেখানেই ফেলা হোক না কেন, তা অক্ষত থাকে। জমিতে এই পলিথিন ব্যাগ পড়ার কারণে জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। নদনদী ও জলাশায়ে পতিত হওয়ার ফলে সেগুলোর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর জলাবদ্ধতার সে সংকট, তার পেছনেও রয়েছে এই পলিথিন ব্যাগ। তা ড্রেনে পড়ে তার পানি নিকাষ ক্ষমতা অকর্যকর করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে তোলার পেছনে এর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকল্প, বজ্রপাত, আট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন ইত্যাদির জন্যও এই পলিথিনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পলিথিন বা পলিথিন ব্যাগের এই পরিবেশ বিপর্যয়কর নানামুখী প্রতিক্রিয়ার কারণে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর বদলে পাটের, কাগজের ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা বলা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বিকল্প ব্যাগের ব্যবহার তেমনভাবে বাড়েনি। পরিবেশ আন্দোলনের (পবা) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেরই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এ শহরের জলাবদ্ধতার জন্য ৮০ শতাংশ দায়ী এই পলিথিন ব্যাগ। সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ কত ব্যবহৃত হয় এবং তার কী ধরনের বিরূপতা পরিবেশ, উৎপাদন ও জীবনযাত্রায় পতিত হয়, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার কীভাবে হচ্ছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব এবং ব্যবস্থা গ্রহণের অক্ষমতাই এজন্য মূলত দায়ী। এটা ঠিক, পলিথিন ব্যাগ সহজে বহনযোগ্য, হাত বাড়লেই পাওয়া যায়, এবং দামও কম। এ কারণেই মানুষ তা ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ যদি বন্ধ করা সম্ভব হতো তাহলে এর ব্যবহারও আপনা আপনি রহিত হতো। আরও লক্ষ্য করার বিষয়, বাজারে উপযুক্ত বিকল্পও যথেষ্ট পরিমাণে নেই। এমতাবস্থায়, সোনালী ব্যাগ সবচেয়ে উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে। একদিকে প্রচলিত পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার ডেডস্টপ করতে হবে অন্যদিকে সোনালী ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার জনপ্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে পরিবেশঘাতক পলিথিন ব্যাগের ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ